Oct 21, 2011

বিলাইচরিত

বাসায় থেকে রাত জেগে দেখলাম, রোজ ভোর সাড়ে চারটার দিকে আমার বিলাই বাবাজির খুব খিদা লাগে। তখন সে সব রুমে যেয়ে সবার বিছানার চারপাশে ঘুরে মেও মেও করে। কিন্তু কারো ঘুম ভাঙেনা। বেচারা খাবার পায় সকাল আটটা সাড়ে আটটার দিকে। 

গত কিছুদিন যেহেতু আমি জেগে থাকছি তাই আমার উপরে তার হম্বি তম্বি বেশি। আজকে রুমের দরজা লক করা ছিলো। সে দরজার সামনে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে, অন্য রুমের দরজা দিয়ে বারান্দাতে গিয়ে, আমার বারান্দামুখি জানালা গলে আমার ঘরে এসেছে। তার বিস্তর মেও মেওতে বিরক্ত হয়ে আমি উঠে ভাত গরম করলাম, মাছ গরম করলাম, সে খুব আগ্রহ করে আমার পিছনে ঘুরলো। কিন্তু ভাত মাছ মেখে সামনে থালা ধরতেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো। থালা নিয়া পিছে পিছে কিছুক্ষণ ঘুরে, শেষে বিরক্ত হয়ে যে মাছের অর্ধেক টুকরা ভেঙে ভাত মেখেছিলাম তার বাকি অর্ধেকটা খেতে দিলাম। খালি মাছটুকু কিছুটা খেলো।

বিলাই সাহেব আমাদের গৃহকর্ত্রী জবার মাখানো ভাত ছাড়া আর কেউ কিছু দিলে খেতে চায়না। বস্তুত বিড়াল ভাতই খেতে চায়না। বেশি করে মাছ দিয়ে ভাত একদম টিপে টিপে মেখে দিলে কিছুটা খায়। মাছের মধ্যে ইলিশ মাছটাই বেশি পছন্দ করে। আর মাংস পছন্দ করে। সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মুরগির গলা। দুধ ডিম একদম খায়না। মানুষের বিড়াল নাকি মুড়ি, টিপ বিস্কিট, আরো কতো কী খায়। এই বিড়ালের খাওয়া নিয়ে নখরাতে আমরা সবাই অস্থির। যদি তার কখনও জ্বর হয় বা রাস্তার বিড়ালের সাথে মারামারি করে ব্যথা পেয়ে আসে বা আল্লাই জানে কী হয়, ওমনি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে ঝিমাতে থাকে। একবার বাইরে থেকে মাইর খেয়ে ঠ্যাঙ ভেঙে এসে খাদ্যগ্রহণ বন্ধ করে দিলো। তখন আমার আরেক বিড়ালপালিকা বান্ধবী বললো টুনা ফিশ ফ্লেভারের ড্রাই ফুড খাওয়াতে। প্রথম প্রথম খালি শুঁকে দেখতো একদম খেতোনা। পরে একটু একটু খাওয়া শুরু করলো নিজে থেকেই। তারপর একদিন, জানিনা কীভাবে, কৌটা খোলা পেয়ে প্রায় এক কেজি ড্রাই ফুড একরাতে সাবাড়। পরদিন বাথরুম পরিষ্কার করতে করতে জান শেষ। তারপর আর ড্রাই ফুড কিনিনাই।

যাই হোক গত বছর পূজাতে জবা বাড়ি গিয়ে ৬দিন ছিলো সেই ৬দিন বিড়াল প্রায় অভুক্ত ছিলো। খালি দরজার সামনে গিয়ে কান্নাকাটি করতো। দরজা খুলে দিলে একটা লাল পাতাবাহার গাছের কচি পাতা চিবাতো। ৪দিনে সব পাতা শেষ। বিল্ডিং সৌন্দর্যায়নের অংশ হিসাবে সব ফ্লোরে কিছু গাছপাতা রাখা আছে, খালি আমরা যেই ফ্লোরে থাকি সেইখানেই আর কোনো গাছ রাখা হোলোনা :(

জবাকে সে'বার ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি আনিয়ে নেয়া হলো। এবছর জবা বাড়ি গেলে অবশ্য বিড়াল তেমন যন্ত্রণা করেনি। মোটামুটি কাজ চালানোর পরিমাণে খেয়েছে। কিন্তু জবা বাসায় থাকলে আর কারো হাতে খেতে চায়না।

গোপালকে যখন বাসায় আনলাম প্রথম, তখন আমার ঘরে একটা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রাখতাম তাকে। রোজ ঠিক সাড়ে চারটার সময় চেও চেও শুনে ঘুম ভাঙতো। উঠে দুধ খাইয়ে আবার ঘুমাতে যেতাম। সকালে উঠে যখন অফিসে যেতাম তখন একটা ডাক দিতাম আর টুকটুক করে সে কোথা থেকে এসে যেনো সামনে এসে হাজির হতো। আমার সাথে সাথে লিফটের সামনে পর্যন্ত আসতো কিন্তু কখনও ভিতরে ঢুকতোনা। এখন দিনের মধ্যে কতোবার ঘরে আসি বাইরে যাই ফিরেও তাকায়না। কোলে নিলে মাঝেমাঝে শান্ত থাকে, তারপর একসময় হাঁচোড়পাচোড় করে নেমে যায়। নিজে থেকে নেমে না গেলে জবা এসে চেয়ে নিয়ে যায়। জবার কোলে কিন্তু খুব শান্ত থাকে। নেমে যাওয়ার কোনো চেষ্টা করেনা। তখন বিলাইয়ের মুখের ভাব দেখে রাগ উঠে। মনেহয় পেটের বিলাই পর হয়ে গেছে। ইচ্ছা করে রাস্তায় ফালায় দিয়া আসি, দেখবো তখন কেমনে ইলিশ মাছের ফুটাঙ্গি করে।

আমি গোপালের সাথে বেশিক্ষণ খেললে, কেন যেন মনেহয়, জবা স্বস্তি বোধ করেনা। যে কাজই করুক, সামনে এসে ঘুরঘুর করে। এবং অবশেষে বিড়ালটাকে নিয়ে যায়। ভাবি, আমাদের পরিবারের মধ্যে আমরা এই বালিকাটিকে আপন করে নিইনি। তাই বিড়াল নিয়ে সে হয়তো এই সংসারের মধ্যে নিজস্ব আলাদা একটা সংসার করেছে। ওকে বলি, তোর বিয়ার সময় বিলাই তোরে দিয়া দিমু। জামাইর বাড়ি নিয়া যাবি এই বিলাই।

জবা এখন ক্লাস সিক্সের বই পড়ে। তবে ইংরেজি এখনও ক্লাস থ্রি-র বইতেও উঠতে পারেনি। হঠাৎ হঠাৎ আমার মনেহয় জবাকে ইংরেজি পড়াতে হবে। কিন্তু পড়া দেবার দিন সে কেনো যেনো পড়া না দিয়ে চিংড়িমাছের চরম মজাদার কোনো ডিশ রান্না করে বসে। আমিও ভুলে যাই।

নারীবহুল আমাদের সংসারে আমাদের পুরানো পোষাক ছাড়াও জবার নিজের নতুন অনেক জামা জুটে যায়। আফটারঅল নিজের জন্য তিনটা কিনলে ওর জন্য একটা কিনতে ইচ্ছা করে। কোন পোষাকের সাথে কী মানায়, কোন ড্রেসের গলা কেমন হয়েছে, কতোটুকু অল্টার করা লাগবে, এই বিষয়ে জবার সাথেই সবচেয়ে ভালো আলোচনা করতে পারি। আত্মীয়স্বজনের বাসায় গেলে সে আমার জুতা, কানের দুল, চুলের কাঁটা ব্যবহার করতে পারে। ভাবতেই ভালো লাগে, আমি কতো ভালো। কাজের মেয়েকে মাথায় তুলে রাখি। কিন্তু তাকে আমরা একটা স্কুলে ভর্তি করে দিইনি। আমাদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়, ওর হয়না। ওর নাকি এখন চোদ্দো বছর। ওর বাপ রুহুনি ওকে বিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যেতে চায়। চিন্তায় আছি, এতোদিনের পুরোনো মেয়েটি চলে গেলে কীভাবে ম্যানেজ করবো সবকিছু। ভাবিনা, সাত বছর বয়স থেকে আমাদের সাথে থাকা যে মেয়েটা ইউটিউব দেখে চুল বাঁধা শিখে, রংপুরের বিদ্যুতহীন গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে দিলে সে কীভাবে ম্যানেজ করবে।

মা অবশ্য বলছে জবাকে রান্না শেখাবে, সেলাই শেখাবে। তারপর ঢাকাতে একটা ভালো ছেলে খুঁজে নিজেই বিয়ে দিবে। এই প্রসপেক্ট পছন্দ হয়েছে। তাহলে হয়তো বিড়ালটা ওকে আসলেই দিয়ে দিবো। মাঝেমাঝে ওদের বাসায় যাবো গোপালকে দেখতে।

1 comment:

Anonymous said...

বেশি দুর্দান্ত লাগলো লেখাটা ! বেশি জোস ! অনেকগুলা অ্যাস্পেক্ট আসছে লেখাটাতে। বিড়াল, মালিকানা, বাসার কাজের মেয়ে... দারুণ লাগসে...