কিছু মাস আগে আমার দাদি মারা যান। সেই উপলক্ষ্যে আমি গ্রামের বাড়ি যাই, অনেক বছর পর। অনেক পরিবর্তন হয়েছে সর্বত্র। তবে বাড়ির জংলা, ছায়াচ্ছন্ন ভাবটির বদল হয়নি।
যখন আমি বাড়িতে ঢুকি, উঠানে অনেক মানুষ। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। আমি দেখি উঠানের মাঝখানে আমাদের কালু কুকুরটি শুয়ে থাকে। এটি আমার ঠাকুমার কুকুর ছিলো। অনেক বয়স এর, ভুরু ধূসর হয়ে গেছে। কালুর একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো, প্রতিবার তার মাত্র একটি করে শিশু হোতো। একবার একটা বাচ্চা হারিয়ে গেলো। তখন রোজ সন্ধ্যাবেলায় সে ডাক ছেড়ে খুব কাঁদতো।
বাড়িতে ঠাকুমা একা থাকতেন। এখন আর কেউ হয়তো থাকবেনা। তাও কুকুরটি রাতে শুতে আসে। কেউ তাকে খেতে দেবেনা। তাও আসে। শেষদিন রাতে আমি তার কাছে গিয়ে বসি, সে নিরাসক্তভাবে আমার হাতে মাথা রাখে। মনেহয় আমাকে আর চিনতে পারেনা। অনেক আগে দেখেছিলো।
যেদিন আমরা চলে আসি, বাড়ির জানালার দিকে চোখ পড়ে। বন্ধ। আবার কে এসে কে জানে কবে এই জানলা খুলবে। জানলার জন্য, বাড়ির জন্য আমার মন খারাপ হয়। কষ্ট করে বানানো কারো বাড়ি। হৃৎপিণ্ডের মতো উন্মুখ জানালা খুলে দিলেই মুখ বাড়িয়ে নদীর বাতাসের ঝাপটা খাবে আমার শৈশব। দাদির মৃত্যুতে বন্ধ জানালার পিছনে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে আমার শৈশব। আমার মৃত্যুতে হারিয়ে যাবে দাদির স্মৃতি। সেই স্মৃতিতে আমার অনেক অপরাধ। এসব কথা কারুকে বলার নয়। কোথাও লেখার নয়।
তবু এই গান শুনে আজ কোথায় যেনো এক অর্গল খুলে গেলো। গান শোনা বন্ধ করে বাড়ি চলে গেলে আবার রিদয় নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। কালিগঙ্গাতে আর স্রোত ফিরে আসবেনা। সোনার গৌর কোথায় চলে গেছে। রিদয় এখন কেবল শুন্য শুন্য শুন্য। তবু চোখ বন্ধ করলে বন্ধ জানলা কেনো ভয় দেখায় আমাকে? ঘুমাতে দেয়না। কালু কুকুর হয়তো ওই বাড়িতেই মরবে। যেদিন আমি চিরদিনের জন্য ঘুমাবো, সেদিন আমিও ওই বাড়িটিতে গিয়া জানলা খুলে দিয়ে ঘুমাতে চাই। বাড়ি, তুমি আমার জন্য থাকবা তো? নদী তুমি থাকবা তো?
2 comments:
কিছু আসলে বলার নাই... লেখাটা আমার এই যাবতকালে পড়া তোমার সেরাগুলির মধ্যে একটা, কিন্তু সেই কথাটা বলাও বোধহয় খাপছাড়া লাগবে। লেখাটার মধ্যে অদ্ভুত একটা শক্তি আছে, যেইটা মন খারাপ করায় দেয়...
আপনার ঠাকুমা'র জন্যে প্রার্থণা করি, আর লেখাটায় অনেক অনেক মুগ্ধতা।
Post a Comment