Sep 3, 2011

মালতীর বারান্দার বাইরে ক্রসফায়ার

একদিন খুব রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, শব্দে। জানালার সাথে লাগোয়া আমার বিছানা। জানালার বাইরে বারান্দা। আমার মনেহয় বারান্দার ঠিক সামনে একটি বোমা বিষ্ফোরিত হলো। তারপর সব চুপচাপ এবং আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি। কতোক্ষণ পরে জানিনা আবার পর পর কিছু বিষ্ফোরণের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি ভাবি বারান্দায় গিয়ে দেখবো কিনা কী হলো। কিন্তু দীর্ঘসময় আর কোনো শব্দ না হওয়াতে আবারও তন্দ্রাচ্ছন্ন হই। শুনতে পাই খুব দূরে কারো খুব কাতর স্বর। আমি বোঝার চেষ্টা করি এটি বাস্তব না স্বপ্ন। আমি বুঝতে পারিনা। ঘুম জাগরণের মাঝখানে জানিনা কতোক্ষণ ধরে আমি খুব দূর থেকে এক অদ্ভুত অশরীরী কাতর ধ্বনি শুনতে থাকি।

পরদিন ঘুম ভাঙতে দেরি হয় বলে তাড়াহুড়া করে অফিসে যাই। অফিসে গিয়ে সবগুলি খবরের কাগজ খুঁজে দেখি। কিন্তু রামপুরা এলাকাতে কোনো সহিংসতার খবর চোখে পড়েনা। কেবল খিলক্ষেতে একটি ক্রসফায়ার হয়েছে বলে জানতে পারি। সন্ধ্যার মধ্যে আমি ব্যপারটি ভুলে যাই।

কিন্তু তিন চারদিন পর রাতে বাবামা যখন খাবার টেবিলে কথা বলছিলো তখন কানে আসে এ এলাকাতে একটি ক্রসফায়ার হয়েছে। ভিকটিমকে নাকি গাড়ির পিছনে বেঁধে নিয়ে খিলক্ষেতে যেয়ে মারা হয়। এলাকার সবাই জানে। ঘটনাটি আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। অফিসের পর শাহবাগে সান্ধ্য আড্ডাতে আমি সব বন্ধুদেরকে এই ঘটনা জানাই। এটি নিয়ে ব্লগে লেখার ইচ্ছা ছিলো তখন থেকেই। কিন্তু বন্ধুবান্ধবরা বলে দিনকাল ভালোনা, নেটে কার কী লেখা থেকে কী হয়ে যেতে পারে কেউ বলতে পারেনা।

তখন ভাবি আসলেই এটা নিয়ে লিখবো কিনা। কিন্তু বেশি ভাবিনা। আমি আসলে বেশিই ব্যস্ত আর কনটেমপোরারি কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে আগ্রহ পাইনা তেমন। এগুলি নিয়ে খুব গভীর করে ভাবাও হয়না। তবে, মানুষ এতো সহজে ক্রসফায়ার মেনে নিয়েছে, এটা আমার মন মানতে পারেনা। কীভাবে সম্ভব।

তাই শেষ পর্যন্ত ঘটনাটা ব্লগে লিখেই ফেললাম। ফেইসবুকে লেখাটা শেয়ার দিয়ে ঘুমাতে চলে গেলাম।

কিন্তু বিছানায় শুয়ে হঠাৎ সম্প্রতি শোনা সেই প্রবাসী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কথা মনে পড়লো, প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু-সঙক্রান্ত ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে তার নাকি চাকরি গেছে। ভাবছিলাম, আমি তো একে হিন্দু মেয়ে, তারউপর বাবা মাও কতো গরিব। তেমন বড়োলোক আত্মীয় স্বজনও নাই, সবচাইতে বড়ো চাকরি করতো যে বড়ো মেসো তিনি কাস্টমস সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন, ১০ বছর হলো রিটায়ার করেছেন। আমার একটা ভাইও নাই। আমাকে তো ভিকটিম বানানো খুব সোজা। একবার ভাবলাম উঠে লেখাটা মুছে দিবো কিনা। কিন্তু নিজেকে এতো বেকুব আর ভিতু লাগলো। তাই লেখাটা থেকে গেলো।

সকালে অফিসে যেয়েও খুব অস্বস্তি লাগলো কিন্তু আমি অফিসে কখনও বাংলাব্লগে ব্রাউজ করিনা, তাই লেখাটা মোছা হয়নি। রাতে নিজেকেই নিজে গালি দিলাম, এমন অবাস্তব কল্পনা মাথায় আসার জন্য। যদিও মনের মধ্যে একটা খচখচানি থেকে গেলো, কিন্তু জোর করেই লেখাটা রেখে দিলাম।

চারদিন পর সন্ধ্যায় আমি বসার ঘরে টিভি দেখছিলাম। কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে দেখি কিছু মাঝবয়সী লোক, হাফশার্ট পরা। তারা বলে তারা পুলিশের গোয়েন্দা। আতংকে আমার কান্না চলে আসে কিন্তু আমি তাদেরকে ভিতরে এসে বসতে বলি। আমার অসম্ভব মন খারাপ লাগছিলো, মা'কে ডাকলাম গলা উঁচিয়ে। মা এসে আমার পাশে বসে টিভির চ্যানেল পালটায়। সেই মুহূর্তে আমি বুঝলাম। আমার হ্যালুসিনেশান হয়েছে।

(চলবে)

No comments: